সাওম বা রোজা ইসলামের মূল ৫ টি স্তম্ভের মধ্যে একটি। মহান আল্লাহ তায়ালা সাওম কে প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। রোজা রাখার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু নিয়ম বা বিধান মানতে হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই সাওম সম্পর্কে বিস্তারিত জানিনা। তাই আমরা আমাদের আজকের আর্টিকেলে সাওম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করবো, ইনশা-ল্লাহ।
সাওম এর অর্থ কি
সাওম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরার প্রথমেই আসে সাওম শব্দের শাব্দিক অর্থ আসলে কি। মূলত সাওম শব্দটি হলো আরবী যার একবচনে হলো সাওম আর বহুবচনে সিয়াম। যার অর্থ হলো – বিরত থাকা, সংযম করা, নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি। সাওম কে আমরা অনেকেই রোজা হিসেবে আখ্যায়িত করি। রোজা শব্দটি হলো একটি ফারসি ভাষার শব্দ। আদি-ইরানীয় ধাতুমূল রোওচাকাহ হতে যার অর্থ হলো – উপবাস।
সাধারনত এশিয়া মহাদেশে কালক্রমে অন্যান্য ভাষার ন্যায় সিয়াম শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে রোজা ব্যবহুত হয়। যা থেকে পালাক্রমে বাংলা ভাষাতে যুক্ত হয় রোজা শব্দ টি। প্রাচীন কাল থেকে বাংলা তে সাওম বা ইসলামের উপবাস বোঝানোর জন্য রোজা প্রতিশব্দ টি ব্যবহার হয়ে আসছে।
সাওম কাকে বলে
সাওম এর শাব্দিক অর্থ হলো – বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় – সুবহে সাদিক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কোনো প্রকার পানাহার বা ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকা কে সাওম বলা হয়।
বছরের মধ্যে একমাস হলো সিয়াম সাধনার মাস। এই মাসে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালা সুবহে সাদিক হতে শুরু করে সুর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত কোনো ধরণের পানাহার করতে নিষেধ করেছেন। পানাহার থেকে এই সময় টুকু নিজেকে বিরত রাখার নাম সাওম। মহান আল্লাহর প্রতি আনুগাত্য ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে সাওম।
সাওম এর পরিচয়
সাওম এর শাব্দিক অর্থ হলো – বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য সকল প্রকার পানাহার থেকে নিজেকে বিরত রাখার নাম সাওম বা রোজা। মহান আল্লাহ তায়ালা এ মর্মে ইরশাদ করেন – “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো” (সূরা বাকারা -১৮৩)
পবিত্র রমজান মাসে কুরআন শরিফ নাযিল করা হয়েছে। বছরের বাকি মাস গুলোর তুলনায় মুসলিমদের কাছে এই মাসটি অনেক বেশি হিদায়াতস্বরুপ। রমজান মাসে সাওম পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি পরহেজগারি হতে শেখায়। রমজান মাসের অনেক ফজিলত আছে। সাওম মানুষের সকল পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শেখায়।
📌 আরো পড়ুন 👇
সাওম পালন করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। এ সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেন –
“রোজাদারের জন্য দুটি খুশি। একটি হলো তার ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।“ (বুখারি ও মুসলিম)
ইতিহাস থেকে জানা যায় – সাওম এর উতপত্তি হয়েছিল হযরত আদম (আ) এর মাধ্যমে। যখন আদম (আ) জান্নাতে নিষিদ্ধ ফল আহার করেছিলেন তখন তিনি তওবাহ করেছিলেন। কিন্তু ৩০ দিন পর্যন্ত তার তওবা কবুল হয়নি। পরবর্তীতে ৩০ দিন পরে তওবাহ কবুল হওয়ার পর আদম সন্তানদের উপর ৩০ টি রোজা ফরজ করে দেয়া হয়। এর পর পালাক্রমে সকল নবী ও রাসূলগন সাওম পালন করতেন।
সাওম কত প্রকার ও কি কি
সাওম কি ও কিভাবে সাওম এসেছে তা আশা করি ইতিমধ্যেই আপনারা জেনেছেন। এবার চলুন জেনে নেই সাওম কত প্রকার ও কি কি সে সম্পর্কে। সাওম কে মূলত ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১। ফরজ রোজা
প্রাপ্ত বয়স্ক নর নারীর জন্য যে সব রোজা রাখতে হবে সেগুলোই মূলত ফরজ রোজা। ফরজ রোজা আবার ৪ ভাগে ভাগ করা হয় যেমন –
- রমজান মাসের ফরজ রোজা।
- যদি কোনো কারনে রমজানের রোজা ভঙ্গ হয়ে যায় তার কাযা রোজা।
- রোযা রাখার যদি মান্নত করা হয় তাহলে সেটা রাখা ফরজ রোযার মধ্যে পরে।
- শরিয়তে স্বীকৃত কারণ ছাড়া রমজানের রোজা ভাংলে কাফফারা হিসেবে ৬০ টি রোজা রাখা।
২। সুন্নত রোজা
মহরম মাসের ৯ ও ১০ তারিখে রোযা রাখা হয় সেটা সুন্নত রোজা।
৩। ওয়াজিব রোজা
নফল রোযা রেখে যদি কোনো কারনে ভঙ্গ হয়ে যায় তা পরবর্তীতে ওয়াজিব হয়ে যায়।
৪। নফল রোজা
যে সব রোজা গুলো সুন্নত, ফরজ, ওয়াজিব নয় তবে অধিক পূণ্যের আশায় রাখা হয় সেগুলোই মূলত নফল রোজা।
৫। মুস্তাহাব রোজা
ইমাম আবু হানিফার মতে, শাওয়াল মাসের ০৬ টি রোজা এক সাথে বা পৃথক পৃথক ভাবে রাখা মোস্তাহাব।
মাকরূহ সিয়াম কি
মাকরুহ সিয়াম কখন হয় সেটা জানার আগে বুঝতে হবে মাকরুহ শব্দের অর্থ আসলে কি। মাকরুহ অর্থ হলো অপছন্দনিয়। আর মাকরুহ সিয়াম হলো যেসব সিয়াম আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। সব ক্ষেত্রে সিয়াম ভেঙ্গে না গেলেও সে পর্যায় চলে যায়। সিয়াম যে সব কারনে মাকরুহ হয় –
- অতিরিক্ত কুলি করা, অযুর সময়ে গড়গড়া করা নাক দিয়ে পানি টানা এর ফলে গলা বা নাকের মাধ্যমে পেটের মধ্যে পানি চলে যেতে পারে যার ফলে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়।
- স্ত্রী কে যৌন আকাঙ্খা নিয়ে চুম্বন করা এতে সহবাস করার ইচ্ছা জাগার ফলে বীর্যপাত ও ঘটতে পারে তাই এ ধরণের ইচ্ছা বাসনা করলে সিয়াম মাকরুহ হয়ে যায়।
- কোনো প্রয়োজন ছাড়া কোনো খাদ্যের স্বাদ জিহবার মাধ্যমে পরখ করা।
ইত্যাদি ছাড়াও রোযা ভংগ হয়না কিন্তু ভংগের আশংকা থেকে এসব কার্যকলাপ করার মাধ্যমে সিয়াম মাকরুহ হয়ে যেতে পারে।
সাওম এর গুরুত্ব
সাওম এর গুরত্ব অপরিসীম। সাওম পালন করার মাধ্যমে একজন মানুষ সব খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। রোজা রেখে কোনো মানুষ অনৈতিক কোনো কাজে লিপ্ত হতে পারে না। সাওম মানুষের মনে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়, আত্নসংযম হতে শেখায়, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করতে শেখায়।
ইসলামের সব ইবাদত এর চেয়ে মহান আল্লাহর কাছে সাওম কে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা রোজাদার কে এতই ভালোবাসেন যে জান্নাতে আলাদা একটি ফটক এর মাধ্যমে প্রবেশ করাবেন। এ সম্পর্কে মহানবী হযররত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন –
“জান্নাতে একটি ফটক আছে। তার নাম রাইয়ান। কেয়ামতের দিন রোজাদাররা সেই ফটক দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অন্য কেউ সেই ফটক দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, রোজাদাররা কোথায়? তখন তারা উঠবে। তারা ছাড়া অন্য কেউ যাবে না। যখন তারা জান্নাতে প্রবেশ করে ফেলবে তখন রাইয়ান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হবে। সুতরাং আর কেউ এ ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।“ (বুখারি – ১৮৯৬)
সাওম এর শিক্ষা
বছর ঘুরে ৩০ দিনের রোজা প্রত্যেক মুমিনের জন্য নিয়ে আসে নাজাত, মাগফেরাত ও রহমতের বার্তা নিয়ে। প্রকৃত মুমিন হিসেবে নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পন এর মাধ্যমে সাওম অনেক কিছু শেখায়। একজন রোজাদার সারাদিন উপবাস থেকে ইফতারিতে এক সাথে খাবার খেতে পারে। এর মাধ্যমে রোজাদার নিজের মধ্যে ভ্রতৃত্ব বোধ শিখতে পারে।
📌 আরো পড়ুন 👇
রোজা সকল ধরণের মিথ্যাচার, অনিষ্ট, অন্যের ক্ষতি, অন্যায় কাজ ইত্যাদি থেকে বিরত রাখতে শেখায়। একজন রোজাদার কখনোই রোজা রেখে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে পারেনা। যা আমাদের শেখায় আমরা আমাদের জন্য সুন্দর একটি সমাজ ব্যাবস্থা তৈরি করতে পারি ইসলামের নিয়ম মেনে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন – আল্লাহ বলেন, সাওম আমারই জন্য। আমি এর যত খুশি বিনিময় দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সাওম সম্পর্কে আমাদের মতামত
সাওম শব্দের অর্থ কি – আর্টিকেলে আমরা সাওম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। আর্টিকেলে কোনো ভুল হলে অবশ্যই আমাদের জানাতে ভুলবেন না। বছরের শুধু একটি মাস সিয়াম সাধণার মাস।
প্রতিটি মুমিন মুসলমান অনেক বেশি অপেক্ষা করে এই মাসের জন্য। এই মাসে বেশি বেশি ইবাদত করার চেষ্টা করুন। বেশি বেশি তওবাহ করুন। আল্লাহ তওয়াবা কারিকে ভালোবাসেন। আর্টিকেল টি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।